সকালে ঘুম থেকে ওঠা কতোটা কষ্টকর তা আমরা সবাই জানি। ঘুমের আবেশে জড়িয়ে থাকার আরাম থেকে উঠতে কারোরই মন চায় না। কিন্তু যতই মন না মানুক, শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা থেকে উঠতে হয়। কিন্তু এই দোটানার মধ্যে থাকতে থাকতেই দেরি হয়ে যায় সকলের। ভোরের পাখি হওয়া আর হয়ে উঠে না। আর পুরো দিনটিই এর প্রভাবে কাটে। সকালে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা যতটা স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ, ঠিক ততোটাই মানসিক প্রশান্তির জন্য খারাপ। সকালের তাজা হাওয়া মন ও স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ভালো। তাই সকালে জলদি ওঠার অভ্যাস করা সকলের জন্য বেশ জরুরী। আর এই ভোরে ওঠার কষ্টকর অভ্যাসকে সহজ করার রয়েছে বেশ ভালো কিছু উপায়। আসুন তবে জেনে নেই এই উপায় গুলো যাতে একটি ভালো অভ্যাস সহজে আয়ত্ত করা সম্ভব হয়।
১. নিজের মনকে পরিবর্তন করুন
অনেক মানুষ ঘুমতে যাওয়ার জন্য যুদ্ধ করে কেননা তারা অনেক কিছু করতে চায়- তাদের একটি দিন থেকে বিচ্যুতির অনিশ্চিয়তাবোধ রয়েছে। বোধহয় দিনটি শেষ হয়ে গেল। কিন্তু মর্গানস্টেইন তার গ্রাহকদের ভিন্নভাবে চিন্তা করতে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। “ধরে নিন ঘুম হচ্ছে পরবর্তী দিনের শুরু”, তিনি বলেন, এ ধরনের চিন্তা ঘুম সম্পর্কে আপনার চিন্তাকে পরিবর্তন করবে ঘুম সম্পর্কে আপনাকে আগ্রহীও করে তুলবে। “ঘুম হচ্ছে একটি সক্রিয় উপাদান, এতে আপনি নিজের ব্যাটারি চার্জ করে নিতে পারেন”।
২. স্মার্ট অ্যালার্ম
প্রচলিত মোবাইলের অ্যালার্ম বা অন্যান্য অ্যালার্ম ঘড়ির ভেতরে ‘স্নুজ’ অপশনটি থাকে, যা চালু থাকলে নির্ধারিত সময়ের অ্যালার্ম থামিয়ে দেওয়ার কিছুক্ষণ পর আবার বেজে ওঠে। এই অবসরে যেন আরেকটু ঘুমিয়ে নেওয়া যায়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঘুম থেকে জেগে ওঠার জন্য বরং ‘স্মার্ট অ্যালার্ম অ্যাপ’ বা ‘ম্যাথ অ্যালার্ম’ ব্যবহার করা উচিত। এ ধরনের অ্যাপ নির্ধারিত সময়ে বেজে ওঠা শুরু করলে থামানোর শর্ত হিসেবে একটি গাণিতিক সমস্যা উপস্থাপন করবে, যা সমাধান না করে অ্যালার্ম থামানো যাবে না।
৩. ঘুমের সময়কে সমন্বয় করুন
আমাদের অনেকেই আছেন যারা ঘুম বঞ্চিত এবং অতিরিক্ত কয়েক ঘন্টা ঘুম চুরি আমাদের ব্যর্থতার দিকেই ঠেলে দিবে। সফল হওয়ার অন্যতম উপায় হলো তাড়াতাড়ি বিছানায় যাওয়া। ঠিক করুন আপনার শরীরের জন্য ক’ঘন্টা ঘুমের প্রয়োজন আর সেখান থেকেই ঘুমানো শুরু করুন। “তাড়াতাড়ি উঠার জন্য মস্তিষ্কের মধ্যেই একটা মৌলিক পরিবর্তন দরকার।” তিনি বলেন, “এই পরিবর্তনটি দিনের পূর্বেই আপনার সমস্ত চেতনাকে তৈরি করবে যে কালকের দিনটি আপনার জন্য খুবই পরিশ্রমের হবে আর এর পূর্বে আপনার কিছু মাত্রায় বিশ্রাম দরকার।”
৪. চক্রটিকে ভাঙ্গুন
আপনি দেরিতে ঘুমাতে যান এবং ঘুম থেকে দেরিতে ওঠেন– আপনার এই ঘুম চক্রটি থেকে বের হওয়া প্রয়োজন। এর জন্য জোর করে হলেও একই সময়ে ঘুমাতে যান এবং ঘুম থেকে জেগে উঠুন। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ১ গ্লাস উষ্ণ দুধ পান করুন, ব্যায়াম করুন। এ কাজগুলো আপানাকে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে সাহায্য করবে।
৫. দুপুরের তন্দ্রাকে এড়িয়ে চলুন
যদি ডাক্তারের পরামর্শ না থাকে তাহলে দুপুরে ঘুমাবেন না। কারণ দুপুরের ঘুমের কারণেই রাতে দেরিতে ঘুম আসে এবং সকালে ওঠতেও দেরি হয়। তাই দুপুরের ঘুমকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য দুপুরে কাজ করুন বা শখের কাজের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করুন।
৬. কফি খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করুন
দুপুরের পর বা বিকাল থেকে ক্যাফেইন খাওয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে আনবেন। এক গবেষণায় বলা হয়, ৪০০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন খেলে ৬ ঘণ্টা পর তা ঘুমের সমস্যা করে। স্বাভাবিক আকারের এক কাপ কফিতেই এ পরিমাণ ক্যাফেইন থাকে। বিকাল ৫টার আগে থেকেই কফি খাওয়া বন্ধ করা উচিত।
৭. দিনের কাজ গুলো তৈরি করুন
মাঝেমাঝে কিছু একটা বিছানায় শুয়ে থাকাকেও ক্লান্তিকর করেনা অথচ আমাদের পরের দিনের কাজের পরিকল্পনা বেশ ভারী। ইচ্ছে করলেই এই রাতেই কালকের কাজগুলোকে একটু গুছিয়ে নেয়া যেতে পারে। যেমনঃ যদি জিমে যান তো আজ রাতেই জিমে যাওয়ার কাপড়গুলো, ইয়োগার ম্যাট, জুতো গুছিয়ে রাখতে পারেন। যদি কাল অফিস যান তো আজ রাতেই কালকের জামা-কাপড়গুলোকে গুছিয়ে রাখতে পারেন।
৮. ঘুমতে যাওয়ার আগে একটি রুটিন তৈরি করুন
ঘুমতে যাওয়ার আগে কিছু কাজ করুন যা আপনার মনকে শান্তি দিবে এবং হাপ ছাড়ার জন্য সময় নিন। যেমনঃ দরজা-জানালা বন্ধ হলো কিনা দেখুন।, পানির কল বন্ধ কিনা, গ্যাসের চুলা বন্ধ কিনা দেখুন। বাত্বিগুলো নিভিয়ে দিন। প্রয়োজনে কিছুক্ষন হাটাহাটি করুন। এই রুটিন কাজগুলো আপনাকে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরতে সাহায্য করবে। এই অভ্যাস আপনাকে সকাল সকাল উঠার সম্ভাবনাকেও বেশ অনেক খানি।
৯. সঠিক পরিবেশ তৈরি করুন
রাতে ঘুমানোর পূর্বে ক্যামোমিল বা ল্যাভেন্ডার এর চা পান করুন বা বই পড়ুন যা আপনাকে শান্ত করতে সাহায্য করবে। প্রতিরাতে এর পুনরাবৃত্তি করুন। সময়ের সাথে সাথে আপনার শরীর এই নিয়মের সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে এবং আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন কখন আপনার বই বন্ধ করা উচিৎ এবং আপনার ঘুমও চলে আসবে। আপনার ঘরের পরিবেশ ও ঘুম আসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি আপনার শোয়ার ঘরটি পরিষ্কার-পরিছন্ন থাকে তাহলে আপনার মন শিথিল থাকবে এবং দ্রুত ঘুম চলে আসবে।
১০. আলো আসতে দিন
হোক প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম- আলোর উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি, কেননা আলোর উপস্থিতি মস্তিষ্কের কাছে বার্তা পৌঁছায় যে, সকাল হয়েছে এবং মেলাটোনিন’য়ের মতো হরমোন নিঃসরণ এখন থামানো দরকার। মেলাটোনিন হরমোন ঘুমের রুটিন নিয়ন্ত্রণ করে। ধরুন, আপনার ঘুম তাড়িয়ে জেগে ওঠা দরকার অথচ ভোর পাঁচটা বাজে, আলো এখনও ফোটে নি। তখন ঘরের ভেতর উজ্জ্বল বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে মস্তিষ্ককে ফাঁকি দিতে পারেন।
১১. ঘুম থেকে উঠে ব্যায়াম
শরীরকে জাগিয়ে তোলার সবচেয়ে ভালো উপায় ঘুম থেকে উঠে ব্যায়াম করা। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপালেশিয়ান স্টেট ইউনিভার্সিটি’র গবেষকরা দেখেছেন, সকালের শরীরচর্চা রক্তচাপ কমায়, মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমায় এবং রাতের ঘুম ভালো করতে সাহায্য করে। উজ্জ্বল আলোতে ব্যায়াম করা সবচেয়ে ভালো। সকালে করার জন্য সাইকেল চালানো বা জগিং হতে পারে চমৎকার ব্যায়াম।
১২. ইলেক্ট্রনিকস যন্ত্র বন্ধ করুন
অন্তত দেড় ঘন্টা আগে আপনি আপনার ইলেক্ট্রনিকস যন্ত্রগুলোর সুইচ বন্ধ করুন। টিভি বন্ধ করুন। বন্ধ করুনমেইল চেক করা, সোসাল মিডিয়ায় বিচরণ এমনকি ই-বই পড়াও। তিনি বলেন, “বিজ্ঞান বলে এগুলো আমারদের শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে এবং অতিরিক্ত উদ্দীপ্ত করে জাগিয়ে রাখে। এটা অনেকটা ঘুমতে যাওয়ার আগে এনার্জি ড্রিঙ্ক পান করার মতো যা কোনো মতেই ঘুমতে সাহায্য করেনা। এর পরিবর্তে বরঞ্চ যা আমাদের মনকে হালকা করে এমন কিছু করা যেতে পারে। যেমনঃ বই পড়া, গান শোনা, ছবি আঁকা অথবা পরবর্তী দিনের জন্য নাস্তা তৈরি করা।
১৩. ধৈর্য ধরুন
একবার ব্যর্থ হলেই চিন্তিত হবেন না। চেষ্টাই হবে আপনার কৌশল। আপনার শরীর হয়তো নির্দিষ্ট ঘুমের ধরনের প্রতি অভ্যস্ত হয়ে গেছে, নতুন অভ্যাস তৈরি করতে কিছুটা সময়তো লাগবেই। তাই আপনার শরীরকে নতুন অভ্যাস আয়ত্তে নিতে সময় দিন। প্রথম দিনই হয়তো আপনি ব্যর্থ হবেন, কিন্তু সপ্তাহ শেষে দেখবেন যে নতুন এই অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেছে আপনার শরীর।